প্রতিবছর ঈদ সামনে রেখে দিনের আলো ফোটার আগেই তাঁতের খট্খট্ শব্দে জেগে উঠত সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লী। শোনা যেত তাঁত বুননের মাকুর আকুর টাকুর শব্দ। হাতে বোনা তাঁতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত বিদ্যুত চালিত পাওয়ার লুমও। মাঝে মাঝেই শোনা যেত তাঁতীদের উচ্চকণ্ঠে ঘুম তাড়ানি গানের সুর। সেখানে এখন কষ্টের সুর, সুনসান নীরবতা। করোনা অতিমারী ও চলমান কঠোর বিধিনিষেধ, তার ওপর তাঁতশিল্পে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজের চাপ এখন নেই বললেই চলে। তাঁত মালিকরা কাপড় বিক্রি করতে না পারায়, বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে তাঁত। ঋণের জালে আটকে পড়ে অনেক তাঁত মালিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিলামে ওঠার উপক্রম হয়েছে তাদের কারখানা ও বসতবাড়ি। প্রতিবছর ঈদ এলেই সরগরম হয়ে উঠত যে তাঁতপল্লী, করোনা পরিস্থিতির কারণে তার সবই যেন থমকে গেছে। করোনার প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার প্রায় সব তাঁত কারখানা। আর বেকার হয়ে পড়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫ লাখ তাঁতকর্মী। লোকসানের ভারে নুয়ে পড়েছে একেকটি তাঁত কারখানা। গত পহেলা বৈশাখ থেকে ঈদ-উল-ফিতর পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক ও শ্রমিক সবাই এখন বিপদে। এ অবস্থায় শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফসহ প্রণোদনা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁত মালিকরা। জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, সদর, কামারখন্দ, বেলকুচি, রায়গঞ্জ, চৌহালী, কাজিপুরে তাঁত কারখানার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হয়। বিশেষ করে উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, পাঁচলিয়া বাজারে সপ্তাহে দুই দিন বিশাল কাপড়ের হাট বসে। এসব হাটে কোটি টাকার বেশি পরিমাণ রং,সুতা ও কাপড় বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসেন এসব হাটে। এমনকি সিরাজগঞ্জের উৎপাদিত কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। তেমন কোন আমেজই নেই এবার। শুধু পহেলা বৈশাখ উপলক্ষেই জেলায় প্রায় ১শ’ কোটি টাকার তাঁতপণ্য উৎপাদিত হতো। সেই বৈশাখ মন্দা যাওয়ার পর ঈদ-উল-ফিতরেও বন্ধ রাখতে হয়েছে কারখানা। আর এ কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁত মালিকরা। করোনায় সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সিরাজগঞ্জের অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতীদের ৬শ’ টাকার কাপড় উৎপাদনে এখন খরচ হচ্ছে ১২শ’ টাকা। তবে করোনা বিপর্যয় ও লকডাউনে হাটঘাট বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি বিপণিবিতানগুলো সরকারী নির্দেশে খুলে দেয়া হলেও বেচাবিক্রি জমে না ওঠায় উৎপাদিত কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধি ও বিক্রি করতে পারছেন না তাঁতীরা।
কারখানা মালিকরা জানান, স্থানীয় সুতার মিলের মালিকরা দফায় দফায় ইচ্ছামাফিক সুতার মূল্য বৃদ্ধি করছে। কারণ হিসেবে তুলার মূল্য বৃদ্ধির কথা বলছে মিল মালিকরা। কিন্তু তুলার মূল্য বেড়েছে পাউন্ডপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা। আর মিলমালিকরা সেই সুযোগ নিয়ে সুতার মূল্য বৃদ্ধি করেছে প্রতিপাউন্ডে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। রং ও কেমিক্যালের মূল্যও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাঁতীদের কল্যাণে কোনো পদক্ষেপ না নিলে তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাদের। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কাপড় উৎপাদনের উপকরণের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির ফলে চৌহালী, এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও সিরাজগঞ্জ সদর এলাকায় ইতোমধ্যে লক্ষাধিক তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। তারা করোনাকালীন অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন। সরকারের সঠিক নজরদারি না থাকায় রং আর সুতার বাজার মিল মালিকদের সিন্ডিকেটে আটকে আছে বলে জানালেন রং-সুতার ব্যসায়ীরা । তাঁত শিল্পের উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখাসহ তাঁত মালিকদের সাথে বৈঠক করে সমাধানের ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা তাঁত মালিকদের।