নিউজ ডেস্ক, খোলা নিউজ-২৪.!
পাশের মসজিদ থেকে কোরআন এনে মণ্ডপে রাখেন ইকবাল
প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে রওনা হন মণ্ডপের দিকে।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল গভীর রাতে শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা)-এর মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফটি নেন। এই মাজার থেকে মণ্ডপে হেঁটে যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ মিনিট। আরেকটি ফুটেজে ইকবালকে মণ্ডপে কোরআন রেখে ফিরে আসতে দেখা যায়।
কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখায় প্রধান সন্দেহভাজন ইকবাল হোসেন কোরআনটি নিয়ে ছিলেন মণ্ডপের পাশের এক মাজারের মসজিদ থেকে।
মণ্ডপে সহিংসতার আগের রাতে তিনি কোরআন শরিফটি হাতে নিয়ে মণ্ডপের দিকে রওনা হন। এরপর মূল মণ্ডপের বাইরে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর কোরআন রেখে ফিরে আসেন ইকবাল। এসব দৃশ্য ধরা পড়েছে ওই এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরায়।
প্রধান অভিযুক্ত ইকবালের সহযোগী হিসেবে অন্তত চারজন এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করছে, ইকবাল গ্রেপ্তার হলেই এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে গত ১৩ অক্টোবর কীভাবে উত্তেজনার শুরু এবং মূল মণ্ডপের বাইরে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর পবিত্র কোরআন শরিফ কী করে এলো, সে বিষয়ে মঙ্গলবার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজ বাংলা।
পূজার আয়োজক, এলাকাবাসী, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার আগের রাত আড়াইটা পর্যন্ত মন্দিরে পূজাসংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি ছিল। এরপর বুধবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দুজন নারী ভক্ত মণ্ডপে এসে হনুমানের মূর্তিতে প্রথম কোরআন শরিফটি দেখতে পান।
নিউজ বাংলার হাতে আসা কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেন, প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল গভীর রাতে কাছের একটি মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফটি নিয়ে মণ্ডপের দিকে রওনা হন। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে সময়টি তখন রাত ২টা ১০ মিনিট।
নানুয়ার দিঘির পাশেই শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারটির অবস্থান। মণ্ডপ থেকে হেঁটে যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ মিনিট। দারোগাবাড়ী মাজার নামে কুমিল্লাবাসীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি রয়েছে মাজারটির। এর মসজিদের বারান্দায় তিলাওয়াতের জন্য রাখা থাকে বেশ কয়েকটি কোরআন শরিফ। রাত-দিন যেকোনো সময় যে কেউ এখানে এসে তিলাওয়াত করতে পারেন।
মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার পর হনুমানের গদা হাতে হেঁটে যাওয়া ইকবাল
আরেকটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, মণ্ডপে হনুমানের মূর্তির ওপর কোরআন রেখে ইকবাল ফিরে আসছেন। কোরআন রাখার সময় তিনি হনুমানের হাতের গদাটি সরিয়ে নেন। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে সময়টি তখন রাত সোয়া ৩টার মতো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিউজ বাংলাকে জানিয়েছে, দারোগাবাড়ী মাজারের মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে যাওয়া ইকবালসহ তিনজন ঘটনায় সরাসরি জড়িত।
তাদের মধ্যে হুমায়ুন কবীরসহ (২৫) দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইকবালকে গ্রেপ্তারের পর তাদের পেছনে আরও কেউ আছেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে বুধবার রাতে দারোগাবাড়ী জামে মসজিদের পেশ ইমাম ইয়াছিন নূরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নিউজ বাংলাকে জানান, মণ্ডপে কোরআন রাখা চক্রের আরেক সদস্য ৩০ বছরের ইকরাম হোসেন। তিনিই ১৩ অক্টোবর ভোরে ঘটনাস্থল থেকে ৯৯৯-এ কল করেন। তারপর ওসি আনওয়ারুল আজিম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি কোরআন শরিফটি উদ্ধারের পাশাপাশি ইকরামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নিয়ে যান।
নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে রাখা হনুমানের মূর্তির গদা সরিয়ে রাখা হয় পবিত্র কোরআন শরিফ। বাঁয়ের ছবিটি মঙ্গলবারের, ডানেরটি বুধবার সকালের।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইকবালের পাশাপাশি ইকরামও রাতে নেশা করেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, ওই রাতে ৩ পিস ইয়াবা সেবন করেন। পরে মণ্ডপের পাশে অবস্থান নেন। মণ্ডপে কোরআন রাখেন ইকবাল। আর ইকরামের দায়িত্ব ছিল ভোরে বিষয়টি পুলিশকে জানানোর। সে অনুযায়ী তিনি ৯৯৯-এ ফোন করেন।
ওসি আনওয়ারুল আজিম মণ্ডপ থেকে কোরআন উদ্ধারের সময় সেটি ফেসবুকে লাইভ করেন ফয়েজ নামের এক যুবক। সেই লাইভের পরেই উত্তেজিত মানুষ জড়ো হন ঘটনাস্থলে, শুরু হয় সহিংসতা। এই ফয়েজকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
প্রধান অভিযুক্ত ৩০ বছর বয়সী ইকবাল কুমিল্লা নগরীর ১৭ নং ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর এলাকার নূর আহম্মদ আলমের ছেলে। নূর আলম পেশায় মাছ ব্যবসায়ী।
ইকবালের মা আমেনা বেগম নিউজ বাংলাকে জানান, তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ইকবাল সবার বড়।
প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন
তিনি জানান, ইকবাল ১৫ বছর বয়স থেকেই নেশা করা শুরু করেন। ১০ বছর আগে তিনি জেলার বরুড়া উপজেলায় বিয়ে করেন। ওই ঘরে তার এক ছেলে রয়েছে। পাঁচ বছর আগে ইকবালের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তারপর ইকবাল চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়া বাজার এলাকার কাদৈর গ্রামে আরেকটি বিয়ে করেন। এই সংসারে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
আমেনা বেগম নিউজ বাংলাকে বলেন, ‘ইকবাল নেশা করে পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার করত। বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটেও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াত।’
ইকবাল মাজারে মাজারে থাকতে ভালোবাসতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সে বিভিন্ন সময় আখাউড়া মাজারে যেত। কুমিল্লার বিভিন্ন মাজারেও তার যাতায়াত ছিল।’
এদিকে সিসিটিভি ফুটেজের বিষয়ে বুধবার রাতে প্রশ্ন করা হলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ নিউজ বাংলাকে বলেন, ‘সব-ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্য অনুসন্ধান চলছে!