মোঃ মেহেদি হাসান ইমন, (পবিপ্রবি প্রতিনিধি)
চীনের উত্তরে লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে আছে গোবি মরুভূমি যা পৃথিবীর শুষ্কতম এলাকা হিসেবেও পরিচিত। একসময় শত শত মাইল পেরিয়ে গেলেও দেখা মিলতো না কোনো গাছের। চীনের আবহাওয়ার উপর এই মরুভূমির শুষ্কতার বিরুপ প্রভাব দেখা যেত প্রতিবছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে। প্রতিবছরের এই সময়টাতে তীব্র ধূলিঝড়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তো চীনের উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানী বেইজিং পর্যন্ত বিরাট একটি অঞ্চল। এই ধূলিঝড় এতোই প্রকট আকার ধারন করতো যে এখানের জনগন পুরো শরীর ভালোভাবে আবৃত না করে বের পর্যন্ত হতে পারতো না। রাস্তা, বাড়িঘরগুলো কয়েক ইঞ্চি ধুলার আস্তরণে ঢাকা পড়ে যেত। মাঝে মাঝেই এমনকি বিমানের উড্ডয়নও বন্ধ করে দিতে হতো। গোবি মরুভূমির তপ্ত বালি বাতাসে ভেসে এসে এমন বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতো যা চীনের মানুষের কাছে ‘ইয়োলো ড্রাগন’ বা, ‘হলুদ ড্রাগন’ নামে পরিচিত।
অন্যদিকে নিয়মিতভাবে মরুভূমির আকার ক্রমেই বেড়ে চলছিলো। প্রতিবছর প্রায় ৩৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছিল। বছরপ্রতি প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নতুন করে ধুলিঝড়ে ঢাকা পড়ছিলো। এই ধুলিঝড় এবং মরুভূমির বিস্তার ঠেকাতে চীন সরকার এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। মরুর বুকে গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চল সৃষ্টির এই পরিকল্পনার দাপ্তরিক নাম ‘থ্রী-নর্থ শেল্টার ফরেস্ট প্রোগ্রাম’ যা, বিশ্বব্যাপী ‘দ্যা গ্রেট গ্রীন ওয়াল অফ চায়না’ নামে পরিচিত।
পরিকল্পনাটি খুব সরল; সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে মাইলের পর মাইল গাছ লাগানো হবে, সরকারি প্রনোদনা দেয়া হবে, চালানো হবে প্রচারনা। তবে দেখতে সরল হলেও আদতে যা কোনভাবেই সহজ কাজ ছিলোনা। যেখানে সাধারন জমিতেই বৃক্ষরোপন কর্মসূচি চালানো কঠিন, সেখানে মরুর বুকে গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চল সৃষ্টি একরকম অসম্ভব বলা যায়। কিন্তু চীন সে অসাধ্যকে সাধন করে। ১৯৭৮ সাল থেকে চীন এই প্রজেক্ট শুরু করে যা ২০৫০ সাল অবধি চালানো হবে। চীনের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলকে ৩ভাগে ভাগ করে প্রতি অঞ্চলে আলাদা স্ট্যাট্রেজি নিয়ে ২০৫০ এর মধ্যে মরুভূমির ৮ কোটি ৬০ লক্ষ একর এলাকা গাছের ছায়ায় ঢেকে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে চীন। ইতোমধ্যেই মরুভূমির মোট আয়তনের ১৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে এ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করা হয়ে গেছে।
চীন সরকার বিনামূল্যে এসব এলাকার মানুষদের গাছের চারা বিতরন করেছে। সরকারের নিয়োজিত কর্মীরা গাছের পরিচর্যা করছে। হাজার হাজার ভলান্টিয়ার দিনের পর দিন গাছ লাগিয়ে যত্ন নিয়ে যাচ্ছে। গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার এই মরু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করে আসা জনসাধারনকেই পরিচর্যায় উৎসাহিত করেছে। এমনকি এর জন্য সরকার তাদের নিয়মিত টাকাও দিচ্ছে। শিশুদের গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহিত করতে চীন সরকার পাঠ্যবইতেও গাছের গুরুত্ব নিয়ে বেশ কিছু অধ্যায় সংযোজিত করেছিল। উত্তরাঞ্চলের স্কুল-কলেজগুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি সপ্তাহে এবং মাসে নিয়মিতভাবে নিয়ে যাওয়া হত বিভিন্ন এলাকাতে মরুভূমির মাঝে লাগানো গাছের পরিচর্যা করতে। এমনকি এটিকে তাদের ক্লাসওয়ার্কের অংশ হিসেবেও নিবন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া ১১ বছরের বেশি বয়সী প্রতিটি নাগরিককে বছরে অন্তত ৩টি করে গাছ লাগানোর আইন করে দেয়া হয়েছিল। দেশের সেনাবাহিনীকেও লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল গাছ লাগানোর এই মহোৎসবে। ব্যক্তি-মালিকানাধীন জমি লীজ নিয়েও লাগানো হয়েছিল লক্ষ লক্ষ গাছ। আলাদা আলাদা ভলান্টিয়ার টিমের হাতে দেয়া হয় আলাদা আলাদা এলাকার দায়িত্ব, যেন একই এলাকায় একাধিক টিম কাজ না করে আবার কোনো এলাকা ফাঁকাও না থাকে। শুরুর পর থেকে গত ৪৫ বছরে ৫০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে অংশ নিয়েছে এই প্রজেক্টে।
এই বিশাল কর্মযজ্ঞের ফল চীন এখনই পেতে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলের মরুর বুকে সবুজ দেয়াল গড়ে তোলার যে স্বপ্ন চীন দেখেছিল তা এখন অনেকাংশেই দৃশ্যমান। যেখানে উত্তরাঞ্চলে বনাঞ্চলের আয়তন ছিল মাত্র ৫ শতাংশ, সেখানে ২০২১ সালে এসে এখানে বনাঞ্চলের পরিমান দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। আবহাওয়াতেও এসেছে লক্ষনীয় পরিবর্তন। উত্তরাঞ্চলের অনেক অংশেই এখন চাষাবাদ হয়। পশুপালন থেকে শুরু করে এখন বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকছে এখানের মানুষজন। এখনও এখানে ধূলিঝড় হয়, তবে তা এখন আর আগের মতো জীবনযাত্রা ওষ্ঠাগত করে তোলে না। ধূলিঝড়ের মাত্রা ও তীব্রতা আগের থেকে অনেক কমে গেছে। আগের তুলনায় তাপমাত্রাও এখন অনেক কমে এসেছে এ অঞ্চলে। মানুষের বেঁচে থাকা হয়েছে আগের থেকে সহজ ও সাবলীল।
১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন গাছের চারা লাগানোর এই মহাপরিকল্পনাকে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন যুগান্তকারী এক প্রজেক্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৫০ সালের আগের চীন তাদের এই কাজে সফল হবে এবং পুরো এলাকার চিত্র পাল্টে যাবে। শুরু থেকেই চীনের এই প্রজেক্ট সমালোচিত হয়েছে। নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়েছে। যৌক্তিক সমালোচনার মুখে গাছের ধরন পরিবর্তন করতে হয়েছে। এমনকি একবার ধুলিঝড়ে একসাথেই প্রায় এক লাখ গাছের চারা মরেও গিয়েছিল। কিন্তু চীনের জনগন কিংবা সরকার হাল ছাড়েনি। এমনকি চীনের অন্যান্য এলাকার মানুষরাও এই প্রকল্পে সাহায্য করছে; তারা ফান্ড সংগ্রহ করে উত্তরে পাঠিয়েছে গাছ কেনার জন্য।
চীনের মহাপ্রাচীর বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য আশ্চর্য। আধুনিক যুগে চীন তৈরি করছে আর এক নতুন মানবসৃষ্ট বিস্ময়। তীব্র খরায় সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাওয়া, কোনো বিপর্যয়ের ফলে বিস্তৃর্ন বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নজির দেখা গেলেও একটি পুরো মরুভূমিকে সবুজ উদ্যানে পরিনত করার নজির বিশ্ব ইতিহাসে একটিও নেই। চীন এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাচ্ছে। এ কথা বলাই যায় যে, মানুষের অপরিসীম সক্ষমতা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার এক কালজয়ী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে দ্যা গ্রেট গ্রীন ওয়ান অফ চায়না।